The Astrological e-Magazine

নিজের মন্দির নিজেই তৈরি করুন

অধ্যাপক ঋষভ শাস্ত্রী


সাধারণ মানুষ তার দৈনন্দিন জীবন-জীবিকা ও সাংসারিক চাহিদা পূরণে ব্যতিব্যস্ত থাকে। ফলে বহু ধর্ম প্রাণ মানুষের পক্ষেই আলাদা করে গৃহ মন্দির তৈরি করে নেওয়া সম্ভব হয় না। আবার অনেকের সাধ আছে, কিন্তু সাধ্য নেই। অনেকের মন্দির নির্মাণের উপযোগী জমি-জায়গা ও সামর্থ্য সবই আছে, কিন্তু মন্দির নির্মাণ সম্পর্কে যথেষ্ট ধ্যান-ধারনা নেই। ফলে মন্দির নির্মাণের ইচ্ছা থাকলেও বহু মানুষ নিজের মনের মত করে মন্দির নির্মাণ করতে পারেন না। সেই সমস্ত মানুষের জন্য আজকের এই সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন ।

বৈদিক বাস্তু শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল দেব বাস্তু বা দেবালয়, সহজ কথায় বাস্তু সম্মত মন্দির নির্মাণ। সনাতন হিন্দু ধর্ম, দর্শন, কৃষ্টি ও উপাসনা রীতি অনুসারে ধর্মীয় জীবন যাপনের জন্য একাধিক পূজার্চনা পদ্ধতি এবং বিভিন্ন সম্প্রদায় বিশেষে স্বতন্ত্র উপাসনা পদ্ধতি প্রচলিত আছে। ফলে মন্দির নির্মাণ রীতির মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য বর্তমান। সারা ভারতে বহুল প্রচলিত সর্বজন স্বীকৃত মূল ধারা অনুসারে “দেব বাস্তু” বা মন্দির বাস্তুর বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব। আসুন দেখে নিই কিভাবে নিজের মন্দির নিজেই করে নিতে পারেন ।

বৈদিক বাস্তু শাস্ত্র অনুসারে মন্দির দুই ধরনের – ১) সর্বজনীন মন্দির, এবং ২) ব্যক্তিগত গৃহ মন্দির। অর্থাৎ জনগণ বা সর্ব সাধারণের পূজার্চনার জন্য নির্মিত মন্দির এবং একক মালিকানাধীন কোনও ব্যক্তির বা পরিবারের নিজস্ব ও ব্যক্তিগত পূজার্চনার জন্য নির্মিত মন্দির।

১) মন্দির নির্মাণের পূর্বে মন্দির নির্মাণের উপযুক্ত জমি নির্বাচন করতে হবে। জমিটিকে মাঙ্গলিক ক্রিয়া কর্ম দ্বারা পবিত্র করে নিতে হবে এবং শুভ দিন ও তিথি নক্ষত্র দেখে ভূমি পূজা করে মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করতে হবে। চতুষ্কোণ, কূর্ম পৃষ্ঠ ও আয়তাকার জমি মন্দির নির্মাণের পক্ষে খুবই শুভ দায়ক।

নিজ বাড়িতে মন্দির নির্মাণ করতে হলে ফাঁকা জায়গায় চারদিক খোলা আকাশের নীচে আলাদা করে মন্দির বানাতে হবে। জায়গা খুব কম থাকলে গৃহের মধ্যে ঠাকুর ঘর করে নেওয়াই ভাল। যাদের পক্ষে আলাদা ভাবে মন্দির বা ঠাকুর ঘর করা সম্ভব নয়, তারা কাঠের, ধাতুর বা পাথরের ছোট মন্দির (সিংহাসন) তৈরি করে নেবেন ও নিত্য পূজার্চনা করবেন।

২) মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরুর প্রথমেই ঈশান কোনে (North-East) পুষ্করিণী (Pond) বা জলাশয় খনন করা উচিত। চলতি বাংলায় এটাকে দুধ পুকুর বলা হয়। প্রথমেই মন্দিরের প্রধান বিগ্রহ অর্থাৎ প্রধান দেব-দেবী নির্বাচন করে ক্রমানুসারে বিগ্রহের উচ্চতা, মূল মন্দিরের নক্সা, বেদি, উচ্চতা ও অন্যান্য অনুসারী দেব-দেবী, মন্দিরের উচ্চতা ইত্যাদি ঠিক করে নিতে হবে।

৩) মন্দিরের জমির ঢাল দক্ষিণ পশ্চিম দিক উঁচু এবং উত্তর-পূর্ব দিকে ক্রমশ ঢালু হবে। দেওয়াল ও অন্যান্য গাঁথনি দক্ষিণ-পশ্চিম দিক মোটা ও অপেক্ষাকৃত উঁচু হবে।

৪) মন্দিরের প্রধান বিগ্রহ বা মূর্তিটি পুরুষ হলে সমকোণী বা চতুষ্কোণ মন্দির নির্মাণ করতে হবে। মন্দিরের প্রধান বিগ্রহ বা মূর্তিটি স্ত্রী হলে আয়তাকার মন্দির নির্মাণ করতে হবে। আয়তাকার মন্দিরে স্ত্রী-পুরুষ বা দেব- দেবী উভয়েরই মূর্তি স্থাপন করা যায়। কিন্তু সমকোণী বা চতুষ্কোণ মন্দিরে কেবল মাত্র পুরুষ দেবতার বিগ্রহ স্থাপন করতে হবে। একাধিক বিগ্রহ স্থাপন করতে হলে পারস্পরিক সম্পর্ক অনুসারে – ডান, বাম ও মধ্য ভাগে বিগ্রহ স্থাপন করতে হবে। প্রধান বিগ্রহের চেয়ে অন্যান্য মূর্তিটি কিছুটা কম উচ্চ হবে।

৫) মন্দিরের উচ্চতা চওড়ার দ্বিগুণ হবে, ভূমি তল থেকে চার পাঁচ ফুট উঁচু সমতলের ওপর মূল মন্দির হবে। মন্দিরের দরজা দুটি পাল্লা বিশিষ্ট হবে। দরজার উচ্চতা চওড়ার দ্বিগুণ হবে। পাদদেশ সহ (বেদি) উচ্চতা দরজার উচ্চতা থেকে ১ থেকে দেড় ফুট কম হতে হবে।

৬) গর্ভগৃহের চার দিকে সমান ফাঁকা জায়গা রেখে নির্মাণ করতে হবে। মূল বেদি মধ্য ভাগে থাকবে। প্রধান বিগ্রহের সঙ্গে অন্যান্য বিগ্রহ রাখতে হলে সম্পর্ক অনুসারে রাখতে হবে। যেমন – রাধা-কৃষ্ণ, হর-গৌরী, লক্ষ্মী-নারায়ণ ইত্যাদি।

৭) প্রধান মন্দির সংলগ্ন চার কোনে চারটি ছোট মন্দির করা যায়। এগুলি মূল মন্দির ও প্রধান বিগ্রহের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট হতে হবে।

৮) মন্দির ছোট বা বড় যাই হোক না কেন সীমানা প্রাচীরের পরে কিছুটা জায়গা ফাঁকা রেখে দিতে হবে। মন্দির প্রদক্ষিণ করার জায়গা অবশ্যই থাকা চাই। প্রদক্ষিণ করার জায়গা না থাকলে মন্দির নির্মাণ যথার্থ বাস্তু সম্মত হয় না।

৯) মন্দির সর্বদা পূর্ব বা উত্তর মুখী হতে হবে। মন্দিরের শীর্ষ (চুড়া) ক্রমশ সরু হয়ে শেষ হওয়া দরকার।

১০) মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ হলে শুভ তিথি, নক্ষত্র ও বিশেষ যোগে – হোম, যজ্ঞ, পূজা-পাঠ ও বিশেষ সেবার মাধ্যমে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে নিত্য পূজার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিদিন কম পক্ষে দুবার ভোগ-আরতি ও পূজার ব্যবস্থা করতে হবে।

১১) সর্বজনীন মন্দির কখনো ব্যক্তি নামে প্রতিষ্ঠিত হবে না। অছি পরিষদ বা ভক্ত মণ্ডলী বা বংশগত সম্পর্কহীন সাত্ত্বিক ও স্ব-ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তির নামে উৎসর্গ করতে হবে। মন্দিরের জন্য কূর্ম পৃষ্ঠ জমি খুবই শুভ। এছাড়া মন্দিরের পূর্ব, উত্তর, উত্তর-পূর্ব দিকে (ঈশান) নদী, হ্রদ, বৃহদ জলাশয়, ঝরনা, মনোরম উদ্যান, পাহাড় ও সবুজের সমারোহ থাকা বিশেষ শুভদায়ক।

১২) মন্দির সংলগ্ন জমিতে –অছি পরিষদের কার্যালয়, সেবাইত ও পূজারীর থাকার ঘর, ভোগ রান্নার ঘর , অতিথি শালা, বিদ্যুৎ সংযোগ ও ইলেকট্রিক মিটার ঘর, দান গ্রহণ ও প্রণামী সংগ্রহ, পানীয় জল, যাত্রী নিবাস, বাগান, গাছপালা রোপণ ইত্যাদি আবশ্যিক কাজ কর্ম বাস্তু শাস্ত্রের সাধারণ নিয়ম মেনে করতে করতে হবে।

উপসংহারে বলি, লেখাটি পড়ে ভাল লাগলে বা বুঝতে কোনো অসুবিধা হলে অবশ্যই জানাবেন। যারা নিজের মন্দির নির্মাণ করতে চান বা যে কোনো ধরনের বাস্তু পরামর্শ চান, তারা যোগাযোগ করতে পারেন।

 

জয় মা তারা –

 

সর্বেসাং মঙ্গলম ভবতু

 

অধ্যাপক ঋষভ শাস্ত্রী

শাস্ত্রজ্ঞ জ্যোতিষী ও জ্যোতিষ গুরু

অধ্যক্ষ শ্রীরামপুর ইন্সটিটিউট অফ মডার্ন আস্ট্রোলজি

E-mail –prof.rishabhshastri@gmail.com

মোঃ 9051879028, 9831695057